Wednesday, January 13, 2016

সমন্বিতা

জীবন মানেই গল্প। গল্পের শুরু আছে, শেষ আছে। জীবনেরও ঠিক তাই। জীবন অনন্তকালের হয় না। তবে কিছু কাজ মানুষকে অনন্তকালের দ্বারে পৌঁছে দিতে পারে।
রুদ্র নিজেকে সাধারণ মনে করে। তবে সে সাধারণ নয় আবার অসাধারণও নয়। বিষয়টা খুলে বলি, তার তিনকুলে কেউ নেই। কোনরকমভাবে এইচ এস সি পাস করেছে। কিন্তু চাকরী পাইনি। এই যোগ্যতায় চাকরী হয় না। আর যা হয় তা রুদ্রের দ্বারা সম্ভব নয়। সে ঢাকা শহরে একা থাকে। খাওয়া, থাকার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। যদি নাহয়, তাতে সমস্যা নেই। তিনদিন পর্যন্ত অভুক্ত থাকার রেকর্ড তার আছে। ফুটপাতে, পার্কে ঘুমিয়ে রাত কাটায়। তার নেশা হল লেখালেখি করা। তার লেখালেখি দেখে এক ভদ্রলোক তাকে কিছু সাহায্য করে। যেমন তার কয়েকটা লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। সেই ভদ্রলোক তাকে একটা মোবাইল গিফট করে। রুদ্রকে তার বাসায় থাকার জন্য বলে কিন্তু রুদ্র রাজী হয়নি। রুদ্র মোবাইলটা নেয় মূলত লেখালেখি করার জন্য। ফেসবুকের একজন তথাকথিত লেখক হয়ে গেছে। অনেকের সাথে রুদ্র পরিচিত। তার ফেসবুকীয় কিছু ভক্ত আছে। তাদের ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ রুদ্র প্রতিনিয়ত লেখালেখি করেই যাচ্ছে।
এদিকে নুসরাত এবার ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। তার নেশা হল গল্প পড়া। কিন্তু ইদানীং তথাকথিত রুটিনবাঁধা প্রেমের গল্প পড়তে পড়তে তার অরুচি ধরে গেছে। হঠাত একদিন একটা নামীদামী পেজে অদ্ভুত একটা গল্প পড়ে। গল্পের লেখককে খুঁজে পেতে তার বেগ পেতে হয় না। গল্পের লেখকের নাম রুদ্র। রুদ্রের সাথে নুসরাতের ফেসবুকীয় বন্ধুত্ব হয়। নুসরাত প্রায়ই রুদ্রের গল্পের প্রশংসা করে। একটা মেয়ের এই প্রশংসা রুদ্রের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
রুদ্র ও নুসরাতের মধ্যে প্রতিদিন কথা হয়। নুসরাতের বয়স কম তাই তার কথায় ফাজলামির ভাগ বেশি। রুদ্র এসব গায়ে মাখে না। একদিন নুসরাত রুদ্রকে মৃত্যু নিয়ে একটা গল্প লিখতে বলল। উল্লেখ্য, তাদের মধ্যে এখন আপনি আপনি নেই, তুমি তুমি এসে গেছে।
-মৃত্যু নিয়ে একটা গল্প লিখবে?
-তা লেখা যায়। হঠাত মৃত্যু নিয়ে লেখার কথা বলছ কেন? সুইসাইড করবে নাকি?
-না। মাটির বিছানায় শোবো।
-ভাল তো।
-তুমি লিখে আমাকে ইনবক্স কর, অবশ্য তা আমার দেখা হবে না।
-এই, ফাজলামি রাখ তো। অনেক আগের একটা লেখা আছে মৃত্যু নিয়ে, পড়বে?
-দাও।
রুদ্র তাকে লেখাটা কপি করে দিল। অনুগল্প ছিল ওটা। পড়েই নুসরাত বলল, তুমি আর লেখালেখি করবে না।
-কেন?
-তোমার লেখা পড়লে তোমাকে মানুষ মনে হয় না। মনে হয় ছায়া। কোন মানুষের পক্ষে এত সুন্দর লেখা সম্ভব নয়।
-দেখ, বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমি ছায়া না, আমি মানুষ।
-তুমি ছায়ামানব। আমি যাচ্ছি। ভাল থেকো। হয়তো আর কখনো কথা হবে না।
কেন যেন রুদ্রের মনে হচ্ছে তার কথা ঠিক। আর কখনো তার সাথে কথা হবে না। হয়তো রুদ্রের তাকে ভাল লেগেছে।
রুদ্র তার ফোন নাম্বার চাইল। নুসরাত বলল, আগে একটা কাজ করতে হবে। আমি একটা নাম্বার দিচ্ছি, তাকে বলবে সে যেন পাগলামি না করে। রুদ্র বুঝতে পারছে না সে কী করবে। রুদ্র ছেলেটার নাম্বার নিয়ে তাকে বুঝালো। এরপর সেই রাত্রে রুদ্রের সাথে নুসরাতের আর কথা হয়নি।
পরদিন সকালে রুদ্র ইনবক্সে একটা মেসেজ দেখল, "থ্যাংকস "। নুসরাত পাঠিয়েছে। যাক, তাহলে মেয়েটা উল্টাপাল্টা কিছু করেনি। এই বয়সী মেয়েদের আবেগ অদ্ভুত। কী করে কী বলে কিছু বুঝার উপায় নেই। রুদ্রের সাথে তার বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস দুটোই পাকা হচ্ছে।
একদিন নুসরাত বলল, সে বেশিদিন বাঁচবে না।
-আবার ফাজলামি শুরু করেছ?
-সিরিয়াস। আমার ব্লাড ক্যান্সার।
রুদ্র বিশ্বাস করে না। তার কাছে ফাজলামি মনে হচ্ছে। তাই সে বলল, কবে থেকে? ক্যান্সার হওয়া তো ভাল।
-আমি মজা করছি না। আমার আয়ু আর বেশিদিন নেই।
রুদ্র এবার বিশ্বাস করল। সেইরাতে রুদ্র তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল ফোনে। কিন্তু নুসরাতের বাসায় সমস্যা আর রাতও অনেক। এতরাতে কথা বলা ঠিক হবে না। তাই সে পরেরদিন কথা বলবে বলে ঠিক করল।
কিন্তু সেদিন নুসরাতের নাম্বার বন্ধ ছিল। রুদ্রের একবার মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টা নাটকীয় আবার মনে হচ্ছে এটাই সত্য। রুদ্রের মন বলছে, নুসরাতের সাথে তার দেখা হওয়া উচিৎ এবং তা খুব দ্রুত। রুদ্র সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নুসরাতের বাসার দিকে রওনা দিল। গন্তব্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল।
চট্টগ্রাম পৌঁছেই রুদ্র সেই ছেলেটাকে ফোন করল। কারণ নুসরাতের ফোন বন্ধ। ছেলেটার নাম জীবন।
-হ্যালো, ভাইয়া কেমন আছেন?
-ভাল, কোথায় তুমি?
-বাসায়।
-তোমার বাসা কোথায়?
-নিউমার্কেট।
-আমি চিটাগাং এসেছি। তুমি কি এমুহূর্তে আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
-হ্যাঁ, ভাইয়া। কোথায় আছেন এখন?
-অলংকার।
-থাকেন, আমি আসছি।
সিগারেট জ্বালিয়ে রুদ্র অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে জীবন চলে এল। তার কাছ থেকে যা জানা গেল তার সারসংক্ষেপ হল, নুসরাতের ক্যান্সার হয়েছে।
রুদ্র জীবনের কাছ থেকে নুসরাতের বাসার এড্রেস নিয়ে চলে গেল।
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল।
নুসরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভিতর থেকে এক মহিলা কন্ঠ শোনা গেল। সম্ভবত নুসরাতের মা।
-নুসরাত, কে এসেছে।
-আমার প্রিয় রাইটার।
আস, ভিতরে আস।
ভিতরে গিয়ে নুসরাত বসতে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে নুসরাতের মা এল।
-আন্টি, আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম। তুমি রাইটার? আমি ভেবেছিলাম বয়স্ক কেউ হবে। তোমার অনেক কথা শুনেছি নুসরাতের কাছে।
-কী বলেছে জানিনা। তবে ও একটু বাড়িয়ে বলে। যাইহোক আন্টি, আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য এসেছি।
-আগে রেস্ট কর। খাওয়াদাওয়া কর। তারপর শুনব।
-না আন্টি, গুরুত্বপূর্ণ কথা দেরী করে বললে গুরুত্ব কমে যায়।
-আচ্ছা, বল।
-নুসরাতের ক্যান্সার হয়েছে কতদিন?
-পাঁচ মাস আগে জানতে পেরেছি।
-ওর চিকিৎসা করাচ্ছেন না?
-করাচ্ছি। তবে ডাক্তার বলেছে....
কথাটা শেষ করতে পারলেন না। কান্নায় গলা জড়িয়ে এসেছে।
-আন্টি, আমার সম্পর্কে নুসরাত কী বলেছে জানিনা। তবে আমি কিছু কথা বলি। আমার কেউ নেই। এইজন্য কাউকে সহজে আপন করে নিতে পারি। নুসরাতকে আমি খুব ভাল একজন বন্ধু মনে করি। আপনি শিক্ষিতা। আপনি বুঝবেন। তার আগে এটা বলেন, ঢাকায় আপনাদের কোন নিকটাত্মীয় আছে?
-আমার ছোট ভাই মতিঝিল থাকে।
-তাহলে, শুনুন। আমি নুসরাতকে কিছুদিনের জন্য ঢাকা নিয়ে যেতে চাই। অবশ্য ফেসবুকীয় পরিচিত একটা ছেলেকে এতটা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, আমি বিশ্বাসঘাতক নই।
-আমি নুসরাতের সাথে আর সবার সাথে কথা বলে নেই। ও যদি যেতে চায়, তাহলে নাহয় আমিও গেলাম।
তুমি রেস্ট কর।
নুসরাতের মা নুসরাতের সাথে আর তার বাবার সাথে কথা বলার পর ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটা মেয়ে যার পৃথিবী যাপনের সময়কাল আর অল্পকিছু দিন, তার কিছু অন্যায় আবদার মেনে নেওয়া যায়। পরদিন নুসরাতের মা, নুসরাত আর রুদ্র রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ট্রেনের মধ্যে এত সময় কাটতে চাচ্ছে না। নুসরাত ও তার মা ঘুমাচ্ছে। তাই কথা বলার মত কেউ নেই। রুদ্র কিছু লেখার চেষ্টা করছে। অদ্ভুত ব্যাপার, সে কিছুই লিখতে পারছে না। অগত্যা হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে থাকল।
"জনম জনম তবে তরে কাঁদিব
যতই হানিবে হেলা,
ততই সাধিব।
জনম জনম তব তরে কাঁদিব। "
ভোররাতে ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে থামল। রুদ্র নুসরাতদের মতিঝিল তাদের মামার বাসায় পৌঁছে দিল। আর বলে আসল, আমি বিকেলে আসব। একটা কথা বলে যাই, মানুষের জন্মমৃত্যু তার অধীনস্থ নয়। কিন্তু মনের শান্তি তার অধীনস্থ। তাই ওর মনে যাতে শান্তি আসে, যাতে সে ভালভাবে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারে সেই চেষ্টাটুকু করতে পারি।
-ঠিক আছে, বাবা। বলেই ভদ্রমহিলা কান্না শুরু করলেন। রুদ্র চলে এল।
বিকেলে রুদ্র বের হল। সে বাসা খুঁজে বের করতে পারছে না। সকালেই তো নুসরাতকে এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল। সে নুসরাতকে কল দিল।
-কোথায় তুমি? আসছ না কেন?
-আমি এসেছি, কিন্তু বাসাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
-তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
নুসরাত চলে এল। রুদ্রকে খুঁজে পেতে কষ্ট হল না। তাকে বাসায় নিয়ে গেল। বলল, আমি চা দিতে বলছি। তুমি চা খেতে থাকো, আমি রেডি হয়ে আসছি।
চা শেষ না হতেই নুসরাত চলে এল। রুদ্রের বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটা মেয়ে এত দ্রুত সুন্দর করে সাজতে পারে তা কল্পনায় ছিল না। দুজনে বাসায় বলে বের হল।
-তুমি যেভাবে সাজগোজ করেছ, আমার নিজের কাছে খারাপ লাগছে।
-কেন? আমাকে দেখতে খারাপ লাগছে?
-আরে না, তোমাকে অপ্সরীর মত লাগছে। আর অপ্সরীর সাথে চলতে একটু অস্বস্তি লাগতেই পারে।
-ও। আচ্ছা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-প্রথমে যাব কাওরান বাজার একটা অফিসে। যদি অফিস টাইম প্রায় শেষ, তবুও যার কাছে যাচ্ছি, তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।
-চল, রিকশা নিই।
রিকশায় উঠে রুদ্র বলল, জীবনের সাথে কথা হয়েছে?
নুসরাত চুপ করে আছে।
-কী হল? হঠাত গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?
-ওর সাথে ব্রেক আপ হয়েছে।
-কি বল? কখন?
-গতকাল। তুমি যখন আমাদের বাসায় গেছিলে, তখন ও আমাকে আর তোমাকে সন্দেহ করছে। আর আমার অসুস্থতা ওর কাছে মিথ্যা মনে হচ্ছে।
মন ভাল করতে এসে মন খারাপ হয়ে গেল।
-যে তোমাকে বিশ্বাস করে না, তার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করার কোন দরকার নাই। ও এখন আমার সামনে থাকলে থাপড়ায়ে দাঁত ফেলে দিতাম।
নুসরাত হাসছে। জোরে জোরে শব্দ করে হাসছে। রিকশাচালক মাঝেমাঝে পিছনে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা কাওরানবাজার চলে এল।
অফিসে এখন লোকজন কম। সরাসরি রফিক সাহেবের অফিসে ঢুকে পড়ল।
-আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কল।
-ওয়ালাইকুম, ইয়াং ম্যান। কেমন আছ? অনেকদিন তোমাকে দেখি না। মেয়েটা কে?
-জ্বি, ও নুসরাত। ওর বাসা চিটাগাং।
-বস, চা নাকি কফি?
-চা। নুসরাত, তুমি কি খাবে?
-কফি।
রফিক সাহেব চাকফির কথা বলল।
-হ্যাঁ, তারপর?
-আঙ্কল, ওর একটা সমস্যা হয়েছে। তা হল, ওর ব্লাড ক্যান্সার।
কথাটা শুনে রফিক সাহেব থ হয়ে গেলেন। সিগারেট ধরালেন আর রুদ্রকেও সিগারেট দিলেন।
-রুদ্র, তুমি বদলালে না।
নুসরাত হা করে এঁদের কথা শুনছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না।
-আমি সারা পৃথিবী হয়তো দেখাতে পারব না কিন্তু ঢাকাশহর দেখাতে পারব। আর অল্প কয়েকটা লোকের সাথে তার দেখা করাব যাদের সাথে দেখা হলে এর ভাল লাগবে। নুসরাত, রফিক আঙ্কল আমাকে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
-কিভাবে?
আমার লেখালেখি প্রকাশ ও প্রচার করার ব্যবস্থা করেছেন তিনি আর তোমার কাছে যাওয়ার খরচ পর্যন্ত তিনি দিয়েছেন। এই লোকটা পৃথিবীর ভাল মানুষদের একজন। যাও, সালাম কর। পুণ্যবান লোকদের সালাম করলে মনে শান্তি আসে। বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় রফিক সাহেব রুদ্রের সাথে কিছু কথা বলল। নুসরাত শুনতে পেল না।
রফিক সাহেবের অফিস থেকে বের হয়ে আবার রিকশা নিয়ে বের হল ওরা।
-রুদ্র, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
-একজন ডাক্তারের কাছে। তবে তোমার চিকিৎসার জন্য না। দেখা করার জন্য। ডাঃ এম আর খান।
-স্যার, আসতে পারি?
-আরে রুদ্র, কী খবর তোমার?
-স্যার, ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?
-হুম, এই পরীর মত মেয়েটা কে?
-ও নুসরাত। আমার বন্ধু।
-নুসরাত, স্যার শুধু একজন ডাক্তার নয়, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অন্যান্য ডাক্তাররা যেমন গুরুগম্ভীর হন, স্যার তার উল্টো। স্যার ভাল গানও জানেন। যাওয়ার আগে স্যারের গান শুনে যাব।
-রুদ্র, তোমার লেখালেখি কেমন চলছে? আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলে, তার কী খবর?
-একটু সময় লাগবে। চাইলে একদিনের মধ্যে লেখা যায় কিন্তু সেই লেখায় আমি নিজেই সন্তুষ্ট হব না।
-ঠিক আছে, নো প্রবলেম। আচ্ছা, তোমার সেই ক্ষত সেরেছে? দেখাও তো...
-দেখানো লাগবে না, স্যার। সেরেছে।
-এই মেয়ে, কী নাম যেন তোমার? ও নুসরাত, তুমি বল। ডাক্তারের চেয়ে কি বেশি বুঝা উচিৎ?
-নো, স্যার। মোটেই না।
ডাক্তার উঠে রুদ্রের জামা উঁচু করে পাঁজরের নিচের ক্ষতটা দেখল।
-হ্যাঁ, সেরে গেছে। কী খাবে বল?
-যা খাওয়াবেন?
-আচ্ছা।
কিছুক্ষণের মধ্যে একগাদা নাস্তা চলে এল। নুসরাত ও রুদ্র অল্প অল্প করে প্রায় প্রত্যেক আইটেম থেকে খেল। ডাঃ এম আর খান কিছু খেলেন না। খাওয়ার পর গান গাওয়া যায় না। ওদের খাওয়া শেষে তিনি গান ধরলেন।
'তুমি কোন কাননের ফুল,
কোন গগনের তারা?
তোমায় কোথায় দেখেছি যেন
কোন স্বপনের পারা।।
এরপর সেখান থেকে বের হল। রাত বেশি হয়নি। আটটা বাজে।
-এখন কোথায় যাচ্ছি?
-আমার আপুর বাসায়?
-তুমি না বলেছিলে তোমার ভাইবোন নেই?
-রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও ভাইবোন থাকতে পারে। প্রাথমিক পরিচয়ে আমি তা কাউকে বলি না। যার সাথে এই কথা বলার মত সম্পর্ক তৈরি হয়, তাকে বলা যায়। যেমন তুমি?
-ও আচ্ছা।
হঠাত দুজনে নীরব হয়ে গেল। যান্ত্রিক কোলাহলের শহরে তাদের এই নীরবতা দীর্ঘস্থায়ী হল না। কথা বলতে বলতে তারা রুদ্রের আপুর বাসায় এসে পড়ল।
দরজা খুলল বারো তেরো বছরের একটা মেয়ে। মামা বলে চিৎকার দিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরল।
-কেমন আছ সুপ্রভা?
-ভাল আছি মামা, তুমি কেমন আছ?
-ভাল। আপু বাসায় নেই?
-আছে, আম্মু কিচেনে।
-নুসরাত, ভিতরে আস।
ভিতরে গিয়ে নুসরাতকে বসিয়ে রুদ্র সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী একটা মহিলা এল। নুসরাত বুঝতে পারছে ইনিই রুদ্রের আপু।
-আপু, আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ নুসরাত?
আপুর মুখে নাম শুনে এবং জড়তাহীন বলার ভঙ্গি দেখে কিছুটা অবাক হল।
-এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
-আপনার বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে আগে থেকেই চিনেন।
-হ্যাঁ, না দেখলেও চিনি। রুদ্র তোমার কথা বলেছে।
-কী বলেছে?
-অনেক কথা। পরে বলছি। খেতে খেতে বলব।
রুদ্র বাইরে গেছে। নুসরাত আর সুপ্রভা গল্প করছে। আপু খাবার রেডি করে খেতে ডাকছেন।
খাবার টেবিলে আপু, সুপ্রভা আর নুসরাত। রুদ্র আসেনি।
-রুদ্র কই? ও খাবে না?
-না। তোমার সাথে কিছু কথা বলি।
-বলেন আপু।
আপু খাবার তুলে দিতে দিতে বলছেন। তিনি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। কারও সাথে কথা বলার সময় শ্রোতাকে তিনি ছাত্র বা ছাত্রী মনে করেন।
-নুসরাত, আমি তোমার সম্পর্কে রুদ্রের কাছ থেকে যা শুনেছি তা হল, তোমার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। হয়তো তুমি বেশিদিন বাঁচবে না। যে জানে যে তার আয়ু মাত্র কয়েকদিন, তার কতটা কষ্ট লাগতে পারে আমি জানি। কিভাবে জানি, তুমি কি বুঝতে পারছ?
-না, আপু।
-আমার মেয়ে সুপ্রভা, ওর কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়। একমাত্র মেয়ের জীবনমরণ সমস্যা, আমি কি ঠিক ছিলাম, বল? আল্লাহ কিছু মানুষকে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠায়। আমার মামা, তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। নাম রফিকুল ইসলাম চৌধুরী।
-ওনার অফিস কি কাওরানবাজার?
-হ্যাঁ, তিনি রুদ্রকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। সে স্বেচ্ছায় তার একটা কিডনি দিতে রাজি হয়। রুদ্রের সাথে এর আগে আমার পরিচয় ছিল না। আমার ভাঙা মন রুদ্র জোড়া লাগিয়ে দেয়। তখন থেকে আমি তাকে ভাই ডাকি। ডাঃ এম আর খানের সাথে দেখা হয়েছিল তোমার। তিনিই এই অপারেশন করেন। আর ডাক্তার জানেন যে রুদ্র.....
-রুদ্র কী, আপু?
-সেরা সৃষ্টির সেরাদের একজন।
-ও মাই গড! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আপু। (নুসরাতের মনে হল, আপু কথা ঘুরিয়েছে)
-এর থেকে অবিশ্বাস্য কিছু আছে যা এখন বলব। হাত ধুয়ে ড্রইং রুমে চল।
ড্রইং রুমের পরিবেশ একদম থমথমে। নুসরাত চুপচাপ বসে আছে। আপুও বুঝতে পারছে না, কিভাবে শুরু করবে। সুপ্রভাও তাদের নীরবতায় যোগ দিল।
দম নিয়ে আপু বলা শুরু করল।
-রুদ্রের আপন বলতে কেউ নেই। লেখাপড়া করেছে মানুষের সাহায্য নিয়ে। একটা চাকরিও করত। কিন্তু একটা সময় তার সে চাকরি আর করা হল না।
-কেন আপু?
-কারণ, ও তোমার চেয়েও অসুস্থ। ওর ব্রেইন ক্যান্সার।
নুসরাতের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সে সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে। সুপ্রভা তার পাশে এসে গা ঘেঁষে বসল।
-একটা জিনিস কি জান, নুসরাত? রুদ্র কখনো মন খারাপ করে না। সে খুব বেশিদিন বাঁচবে না। বিদেশে গিয়ে অপারেশন করলে হয়তো সুস্থ হবে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু সে অপারেশন করাবে না। তার কথা সে ভাল আছে।
-ও আসছে না কেন আপু?
-ও আসবে না। তুমি থাকো আজ রাতে। একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি।
-কী কথা?
-রুদ্র তোমাকে ভালবাসে।
নুসরাত কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
-ও থাকে কোথায়?
-ও কোথায় থাকে কেউ জানে না। ও কাউকে জানায় না।
-ফোন করলে আসবে না?
-ওর ফোন বন্ধ। নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলবে। ও এমনই। বড় অদ্ভুত ছেলে। এমন মায়া জানে যার সৃষ্টি এ পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাও।
নুসরাতের দৃষ্টি শূন্যে আটকে আছে। অশ্রু তার সাথে খেলা করছে। টলমল করছে কিন্তু পড়ছে না। সেই টলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে সুপ্রভা।

No comments:

Post a Comment