Wednesday, January 13, 2016

অসাপ্ত ভালবাসা

আমি একজন ডাক্তার। মোটামূটি এই শহরের সবাই আমাকে চিনে। ফলে অনেক রোগিই আসে। তবে তাদের মধ্যে একজন আছে যে একটু অদ্ভুত টাইপের। ছেলেটার সমস্যা মানসিক। ওকে বলেছিলাম একজন ভাল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এর কাছে যেতে।কিন্তু ও বলেছিল হয় আমিই পারব, নাহলে কেউ পারবে না। মাঝে মধ্যে ছেলেটা এমন কিছু কথা বলত যা শুনলে যে কারো শরীর দিয়ে ঘাম ছুটবে। এইত এক সপ্তাহ আগে ও আমার কাছে এসে একটা ডায়েরী দিল। দিয়ে বলল, আমি যেন পরি। আর বলল, যাকে ভালবাসা যায়, তাকে ভালোই বাসা যায়, আর কিছু করা যায়না। কি অদ্ভুত কথা!! ছেলেটার ডায়েরীটা বাসায় আমার টেবিলের উপর রেখে এসেছি। পড়তে ইচ্ছা হয়নি। পাগলের ডায়েরী, পড়ে কি লাভ!
..
কিছুক্ষন আগে আমার সহকারী এসে জানাল ওই ছেলেটা কাল রাতে মারা গিয়েছে। মারা গিয়েছে বললে ভুল হবে। ও নাকি ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ছিল... তারপর সারারাত ধরে রক্তক্ষরন হয়েছে।..
মানুষ সুইসাইড করে যে কি পায়! বুঝিনা। বাসায় যেতে হবে। এখনো বিয়ে করিনি। তাই নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়।
ঘুমানোর আগে হঠাৎ করে ছেলেটার ডায়েরী টার কথা খেয়াল হল।পাগলের ডায়েরী পড়ে ঘুম নষ্ট করব? ধুর, পড়েই দেখি কি আছে।ডায়েরীটা খুললাম, একটা মেয়ের ডায়েরি। অতঃপর....
..
আজ ভার্সিটি জীবনে ১ম দিন গেল আমার। খুব মজা হল। তার উপর এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল যেটা বলার মত না। এই প্রথম আমি কোন ছেলেকে দেখে ক্রাশ খেয়েছি। আসলে ওর কথা বলার ভঙ্গি আমায় পাগল করে দিল। অনেকক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কয়েকবার চোখে চোখ পড়েছে।ধরা খেয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। ছেলেটার নাম নাকি বিপ্লব। ভালোই নামটা।
ওহ আমার নাম অনামিকা। বাবা চাকুরী করেন। মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। কিন্তু ছেলেটার পোষাক দেখে মনে হয় ও অনেক বড়লোক। কিন্তু আমি ত গরীব, আমাকে ও কি ভালোবাসবে??
..
আজো ছেলেটার সাথে আমার চোখাচোখি হল। কি জ্বালা বাবা!! তারপর ক্লাস থেকে বের হতেই আমাকে ডাকল। তখন কি আনন্দ যে হচ্ছিল, বলে বুঝাতে পারব না।
-একটু শুনবেন (বিপ্লব)
-হ্যা (অনামিকা)
-আপনার নাম?
-অনামিকা..
- আমি বিপ্লব। আমরা ফ্রেন্ড হতে পারি?
-হুম,, পারি।
-তাহলে তুমি করে বলি?
-হ্যা,
..
আচ্ছা ও এত তাড়াতাড়ি আমার সাথে কিভাবে নিজে নিজে কথা বলল?? যা হোক। আমি ওকে বুঝতে দিব না। যে আমি বড়লোক নই।তাহলে হয়ত ও আমায় ছেড়ে যাবে। ইসস আজকেই যদি প্রপোজ করত। আমি আজকেই উত্তর দিতাম।
..
.
[ডায়েরীটা পড়তে ইচ্ছা করছে। আবার করছেনা। ঘুম ধরপছে আমার।
..
(এরপর দুজনের বন্ধুত্বের পথচলা, আস্তে আস্তে ওরা আরো কাছে আসে। অতঃপর বিপ্লব অনামিকাকে প্রপোজ করে। আর অনামিকা রাজি হয়ে যায়। কারন অনামিকা এটাই চাইছিল।)
-অনামিকা? কথা ছিল (বিপ্লব]
-হু [অনামিকা)
- ভালবাসি
- কাকে
- তোমায়
- ঢং
- সত্যি বলছি
- ইসসস...এতদিন পর??? গাধা
-মানে?
- প্রথম দিনেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছিলাম আমি। বুঝনি?
- ইয়ে...না। যাহোক। ভালবাসি তোমায়
- আমিও
- কি?
- ভালবাসি....
..
প্রায় ২ মাস হল।ওরা চুটিয়ে প্রেম করছে। এদিকে বিপ্লব এখনো জানেনা যে অনামিকা মধ্যবিত্ত,বড়লোক নয়। আবার অনামিকাও বিপ্লবের সম্পর্কে অত কিছু জানেনা। শুধু জানে ওর বাবা বিদেশে ব্যাবসা করে। ওরা অনেক সুখি। মাঝে মাঝেই বেড়াতে যায় দুজনে, বিয়ের কথা, পরবর্তী জিবনের কথা আলোচনা করে। তারই মাঝে একদিন বিপ্লবের বন্ধুর ফ্লাটে যায় ওরা ফুর্তি করতে। অনামিকা বাধা দেয়নি কারন খুব বিশ্বাস করত বিপ্লব কে। আর পাশাপাশি খুব ভালবাসত ওকে। তাই অন্ধের মতই নিজের সব সঁপে দিল বিপ্লবের হাতে।
.
এদিকে আজ অনামিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিপ্লবকে বলবে যে ও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। কারন ও জানে বিপ্লব ওকে ছেড়ে যাবেনা।
তারপর ও বিপ্লবকে নিজের সম্পর্কে বলল। তারপর যা হওয়ার তাই হল।বিপ্লব ওকে প্রচুর অপমান করল। ও যে বিপ্লবএর স্ট্যাটাস এর না সেটাও বুঝিয়ে দিল। পাগলি মেয়ে বুঝতেই পারল না কি হয়ে গেল...অনামিকা কাঁদতে লাগল কারন ওর মান সম্মান বিপ্লবের হাতে। বিপ্লব ওকে বিয়া না করলে ও কাউকেই মুখ দেখাতে পারবেনা। তাই ও সিদ্ধান্ত নিল যে বিপ্লবের বাসায় গিয়ে ওর বাবার সাথে কথা বলবে,উনি না থাকলে ওনার সাথে ফোনে কথা বলবে। কিন্তু অনামিকা কখনো বিপ্লবের বাসায় যায়নি। যদিও বিপ্লব বাসার ঠিকানা দিয়েছে। পরেরদিন অনামিকা বিপ্লবের বাসায় গেল। কিন্তু এখানে এসেই ও পরল আরেক ঝামেলায়...
-এটা কি বিপ্লবের বাসা? (অনামিকা)
-না ত (মালিক)
-কি বলছেন? বিপ্লব আপনার ছেলে না?
- না, মা। তুমি ভুল স্থানে এসেছ। আমার কোন ছেলেই নেই।
-কিন্তু....
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল ও। কারন বিপ্লব ওকে ভুল ঠিকানা দিয়েছিল।কিন্তু কেন??? তারপর অনামিকা ওর কিছু বান্ধবীর সাহায্যে বিপ্লবের বন্ধুদের হাত করল আসল খবরের জন্য। এরপর ও যা শুনল, পুরো হার্ট এটাক হওয়ার অবস্থা..
অনামিকাকে বিপ্লব শুধু ব্যাবহার করেছে। আর কিছুই না। বিপ্লব একটা প্লে বয়। আর ও নিম্নবিত্ত। ওর বাবা-মা কেউ নেই। বড়লোক মেয়েদের ফাসানো ওর পেশা। কিন্তু অনামিকাকে দেখে বুঝতে পারেনি ও বড়লোক নয়। তাই প্রেম করেছে।তারপর মধু খেয়ে কেটে পড়েছে....
.
নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর। কি করল!!!! কাউকে মুখ দেখানোর মত অবস্থায় নেই ও...অনামিকা সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক বিপ্লবকে ভাল পথে আনতে হবে।নাহলে যে মরা ছাড়া ওর আর গতি নেই...
..
বিপ্লবকে আঠার মত জড়িয়ে ধরে আছে অনামিকা। হঠাৎ বিপ্লব নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।
-কি চাও তুমি? ( বিপ্লব)
-আমি সব জানি (অনামিকা)
-কি জানো?
-তোমার আসল রুপ বিপ্লব।
- তা তা তা... আম আম আমি কি করব (ভয় পেয়ে)
- দেখো, আমি তোমাকে ভালবাসি
- তুমিও আমায় ঠকিয়েছ, আমি ভালোবাসিনা
- তুমি এটা করতে পার না বিপ্লব। আমি সব তোমাকে দিয়েছি।
- প্রেম এ এটা হবেই। তা চেয়ে আমায় ভুলে যাও...বাই
বলেই চলে গেল বিপ্লব।কিন্তু অনামিকা হাল ছাড়ছেনা। ওকে যেভাবেই হোক মানাতে হবে।
আজ প্রায় ২ মাস হল অনামিকা বিপ্লবকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বিপ্লব মানতে নারাজ। অনামিকা ওর জন্য সব পথই চেষ্টা করল। অবশেষে ভার্সিটিততে সবার সামনে বিপ্লবের জন্য হাত কাটল অনামিকা।
বিপ্লব তবুও কিছু করেনি। অনামিকাকে হাসপাতালে পাঠানো হল। বিপ্লব ভুল করেও ওর কথা ভাবেনি। ওর কি হল সেটা জানতেও চায়নি।
এই ঘটনার প্রায় ১ মাস হল অনামিকা ভার্সিটি আসেনা। এবার বিপ্লবের একটু খারাপ লাগতে শুরু করল। কারনটা হয়ত সেও বুঝল যে ও অনামিকাকে ভালবাসতে শুরু করেছে। একটা মানুষের জন্য কেউ এতকিছু করতে পারে?? সবার সামনে ওকে প্রত্যেকবার অপমান করেছে বিপ্লব।তবুও মেয়েটা দমে যায়নি। যতদিন ওকে বিপ্লব দেখেছে চোখে আগুন জ্বলেছে।কিন্তু এখন ওকে মিস করতে শুরু করেছে। তারপর অনামিকার এক বান্ধবীর কাছে শুনল যে হাসপাতাল থেকে অনামিকা ফিরেছিল। কিন্তু তারপর আর যোগাযোগ হয়নি।ওর বাসার কেউ ও কিছু বলেনি।
ধীরে ধীরে অনামিকার প্রতি বিপ্লবের আকর্ষন বাড়তে শুরু করল। কিন্তু বিপ্লব নিরুপায়। কারন ও ঠিকানা জানত না। এরপর ও অনামিকার বান্ধবীর কাছে গিয়ে ওর বাসার খোজ নিল। তারপর ওর বাসায় গেল।
-আমি বিপ্লব
-তুমিই তাহলে বিপ্লব। কেন এসেছ
-অনামিকা?
- নেই
-নেই মানে??
- দাড়াও
এরপর অনামিকার মা বিপ্লবকে একটা ডায়েরি দিলেন। আর শেষ পাতার চিঠিটা পড়তে বলে উনি বাসার দড়জা বন্ধ করলেন।
বাসায় এসে বিপ্লব প্রথমে ডায়েরী দেখল। যেটা আমি এখন পড়ছি। ডায়েরীটাতে ও তেমন কিছু পেল না।ওখানে অনামিকার হাত কাটার ঘটনা পর্যন্ত লেখা। তাহলে চিঠি?সেটাই খুলল বিপ্লব,
বিপ্লব, জানতাম তুমি একদিন আসবে। আমার ভালবাসা সার্থক।কারন তোমার শত ঘৃনাকে আমি ভালবাসায় রুপ দিতে পেরেছি।
কিন্তু আফসোস আমার! তুমি বড্ড দেরী করে ফেলেছ গো। আমি যে আর তোমার কাছে নেই। অনেক দূরে আমি। ওই তারাদের কাছে আছি।
কতবার তোমায় বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি, তোমার আমার ভালোবাসার ফসল আমাদের সন্তান আমার গর্ভে, অথচ তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ। কি পরিচয় দিতাম আমি ওর?? আর পৃথিবীটাকে বা কি জবাব দিতাম বল? কি বলতাম? ওর বাবা নেই? নাকি বলতাম ও পাপের ফসল? ভালোবাসা যদি পাপ হয় তাহলে যারা ভালবেশে বিয়ে করে তাদের বিয়েটাও পাপ।
যখন প্রথম জানলাম আমি মা হতে চলেছি, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম বাচ্চাটার কথা ভেবে। কারন ওর বাবা ওনেক দূরে। আমি লোকলজ্জার ভয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার নিষ্ঠুর বাবা মা সেটা হতে দিলনা। তারা ঠিক করল, আমার বাচ্চা নষ্ট করাবেন। ডাক্তার বলেছিল খুব রিস্ক আছে। আর আমি মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে যদি অপারেশন টেবিলে মরি তো ভাল, নাহলে সুইসাইড করব। আমার জীবনের কন মানে নেই গো।.... জানি না কি হবে। ভাল থেকো। বিদায়..
.
তোমার অনু
.
চিঠিটা পড়ে কাঁদতে লাগল বিপ্লব। ও নিজের দোষে কতগুলো জীবন ধংস করে ফেলেছে। কি করবে ও এখন। নিজের খারাপ কাজের জন্য আজ নিজেকেই খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।
এরপর ও নিজেকে শেষ করার সব কাজ শুরু করল। আস্তে আস্তে নেশা করা শুরু করল। এমন হল যে ও সবসময় সিগারেট টানত। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মেশা বন্ধ করেদিল। ওর আর কোন মেয়ে ফ্রেন্ড থাকলো না। তারপর ও যত মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিল, তাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইল। কেউ কেউ ক্ষমা করেদিলেও অনেকে করেনি।
বিপ্লব আর আগের বিপ্লব রইল না। কংকালসার দেহ,হাতে সিগারেট সবসময় থাকত ওর। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত, সিগারেট নিয়ে। আর রাত হলেই খোলা আকাশের নিচে বসে সিগারেট টেনে জোড়ে জোরে কান্না করত। ওর কিছু আত্মীয় ওকে ভাল করতে চেয়েও পারেনি। সবসময় ওরমুখে শুধু অনামিকা নামটা থাকত। রাস্তায় কোন বাচ্চাকে দেখলেই কেঁদে উঠত। এরপর খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল। তারপর অনামিকা যেই হাসপাতালে মারা গিয়েছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
আস্তে আস্তে বিপ্লবের অবস্থা খারাপ হতে থাকল। ও পাগলের মত হতে থাকল। তারপর ডাক্তারের কাছে মানে আমার কাছে এসেছিল। যদিও আমি ভালমত ট্রিটমেন্ট করিনি।কারন ও আমার রোগিই নয়,ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল।ওকে বাঁচানোর পথ ছিল অনামিকা।অথচ অনামিকাই নেই....
.
তারপর যা হওয়ার তাই হল। অনামিকাকে দেয়া কষ্ট একটু হলেও নিজে পাওয়ার জন্য ও নিজের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করতে লাগল। এরই মধ্যে একদিন হাতের রগ কেটে যায় এবং ও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়।
.
.
.
অনেক রাত হল। ডায়েরীটা বন্ধ করলাম। কাল সকালে চেম্বারে যেতে হবে। আর একটা কথা খেয়াল হল, কয়েকমাস আগে একটা মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল আমার কাছে। বাচ্চা নষ্ট করানোর জন্য। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় ওর। অপারেশন টেবিলেই মারা যায় মেয়েটি। ওর নাম যেন কি ছিল.......হ্যা অনামিকা....

No comments:

Post a Comment